আজ-  ,


সময় শিরোনাম:

তিন সত্যি; সত্যের উপলব্ধি

গ্রন্থালোচনাঃ

তিন সত্যি; সত্যের উপলব্ধি
-শামীমা রিতু

নিজের মনকে যখন নির্দিষ্ট বিষয় থেকে অন্য কোন দিকে সরিয়ে রাখতে চাই তখনি আমি বইপড়াকে অবলম্বন করি।বই তখন মনকে চুম্বকের মতো তার দিকে টেনে নেয়। কাজের অবসরে কিংবা কাজে মনোযোগ বেশি দিতে বই আমাকে অনেক সাহায্য করে। সাইকোলজি অনুসারে মানুষের মস্তিষ্ক দিনের চাইতে রাতে বেশি সক্রিয় থাকে।নিজের বিবেচনায়ও দেখেছি তা অনেকটা সত্যি, যদিও সেটা সবার ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য নয়।

আমার মনকে তাই অন্যদিকে ধাবিত করার জন্য হাতে নিলাম কবি দিলারা রুমা এর গল্পগ্রন্থ “তিন সত্যি”। বইটি ২০২২ সালের একুশে বইমেলায় লিখন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রকাশক গুণী লেখক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক লিখন আর চমৎকার প্রচ্ছদটি ডিজাইন করেছেন গুণী প্রচ্ছদশিল্পী আইয়ুব আল আমিন।

বইটির শুরুতেই চমৎকার তিনটি লাইন লেখা রয়েছে-
“যার চোখ জুড়ে আমার কবিতা
যারি তরে আমার হৃদয়ের টান
প্রিয় ভালোবাসা আমার প্রিয় গান”।
তিনটি লাইন যেন বিরাট কোন উপন্যাসেরই প্রতিচ্ছবি।

“তিন সত্যি” বইটিতে মোট ১৯টি গল্প রয়েছে যার প্রত্যেকটিতেই পৃথক জীবনবোধ ও সত্ত্বার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রতিটি গল্পের নামকরণ একেবারে সার্থক। যেমন ফলাফল- গল্পে দারুন ভাবে মানুষের কর্মফলের উপলব্ধিকে প্রকাশ করা হয়েছে। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লে এবং গভীর ভাবে ভাবলে সহজেই এ সত্যতা বুঝতে পারা যায়। লেখক অত্যন্ত নিপুণতার সাথে শব্দ মালায় নিজের মনের ভাবকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

গল্পের চরিত্রগুলোকেও খুব শক্তপোক্ত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শেফালীর হাসি, ফলাফল, অভিশাপ, বিশ্বাসঘাতক, প্রেম, বোধোদয়, বাঁশী, তিনসত্যি, আধুনিক বৌ, জ্যোৎস্নার ঢেউ, দীর্ঘশ্বাস সহ প্রতিটি গল্পের প্রতিটি চরিত্র স্বমহিমায় গল্পকে নিয়ে গিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। প্রতিটা গল্পেই যেনো মিশে আছে বাস্তবতার ছোঁয়া। সেই সাথে গল্পের মাঝেই প্রতিফলিত করা হয়েছে সমাজ আর সভ্যতাকে।

সভ্যতা আর সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হলো বই। বইয়ের আয়নাতেই দেখা যায় একেকটা যুগকে। যুগের চাহিদা ও এর প্রভাব গল্পাকারে তুলে ধরেছেন লেখক। সময়ের সাথে সাথে কিভাবে বদলে যায় পুরো একটি পরিবার, সমাজ ও সভ্যতা এগুলোরই নান্দনিক প্রকাশ হলো “তিন সত্যি” গল্পগ্রন্থ। শুধু বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট নয়, প্রবাসী কথাসাহিত্যিক দিলারা রুমা বিলাতের অতীত ও বর্তমান পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানকেও ফুটিয়ে তুলেছেন তার গল্পে। মানুষকে দূর থেকে দেখে অন্যরা কতোইনা সুখি মনে করে! বাস্তবিক অর্থেই কি অর্থবিত্ত আর উন্নত দেশে বাস করলেই মানুষ প্রকৃত সুখ পায়? লেখার গভীর উপলব্ধি সে গুলোকেই স্পর্শ করে।

গল্পের নান্দিকতায় প্রকাশ পায় লেখকের মানসিক চেতনা, যার চমৎকার প্রতিফলন দেখেছি আমি প্রতিটি গল্পের বর্ণনা ও চরিত্রে। পরিবারে বাবা মায়ের দায়িত্ব, সন্তানের প্রতি আচরণ, বন্ধুর সাথে সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আর এর সাংসারিক জটিলতা “জ্যোৎস্নার ঢেউ” গল্পে শুকতারার মতই স্পষ্ট। মানুষের মননশীলতার বিকালের অন্যতম মাধ্যম হলো বই, তাই “তিন সত্যি” গল্পগ্রন্থটি আমার কাছে অনেক শিক্ষণীয়। কেননা, এই বইয়ের উনিশটি গল্পের প্রতিটি গল্পই স্বতন্ত্রভাবে শিক্ষা দেয় সততা, ন্যায়, সাংসারিক দৃঢ় বন্ধন, সন্তানের প্রতি সঠিক যত্ন আর পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসার। যে ভালোবাসা মানুষকে মন মতো বাঁচতে সাহায্য করে, প্রেরণা যোগায়, জীবনের কঠিন সময়গুলোতে নিজেকে শক্ত রেখে মোকাবেলা করতে শিখায়। বই শুধু বই নয়, একে উপলব্ধি করতে হয় মনের গভীর থেকে। তবেই লেখকের ও পাঠকের সার্থকতা।

উনিশটি গল্পের মধ্যে প্রতিটি গল্পের কাহিনীই আমার মন ছুঁয়েছে। ফলাফল কিংবা জ্যোৎস্নার ঢেউ! মানুষের জীবন কী সুন্দরভাবে চিত্রিত হয় শব্দে, বাক্যে! কতো স্পষ্টতার সাথে শোনা যায় কারো জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার প্রতিধ্বনি! জীবনবোধ কতো রহস্যময়। গল্পগুলো পড়তে গিয়ে অনেক জায়গায় মন আটকে গিয়েছে। কতো বেদনায় তীব্র অনুরাগে মানুষ জীবনের পথ পাড়ি দেয়। কঠিন থেকে কঠিনতর সিদ্ধান্ত নেয়। আবার নতুন করে বাঁচতে শিখে। ভরসার জায়গা কখনো তাকে ছেড়ে যায়, আবার নতুন কেউ আঁকড়ে ধরে! আহা জীবন। জীবন থেকেই গল্প হয় কিন্তু জীবনটা গল্পের চেয়েও ঘটনা বহুল।গল্পের ইতিটা ইচ্ছামতো টানা গেলেও জীবনের ইতিটা ইচ্ছামতো টানা যায় না।

দিলারা রুমা’র তিন সত্যি গভীর রাতে জোৎস্নার আলোতে যখন পড়েছি তখন আমার সামনেও যেনো ভাসছিলো “সেই দিনগুলি- রাতগুলি” তবু সত্যি মানতে হয়, আমরা স্বীকার করি বা না করি তাতে কিন্তু সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না। সে সত্যই থাকে। আর এটাই চিরন্তন সত্য। দিলারা রুমা’র প্রতি অবিরাম ভালোবাসা….
অনুলিখনঃ স’লিপক।