গুরু-শিষ্য তত্ত্বের সেকাল একাল এবং আরকুম শাহ্ (রহঃ)
-মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী
মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ জগতে আলোকিত হয় তাঁর কর্মে, সাধনায়, তাঁর অমরত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে। কি’বা ধর্মকর্মে, কি’বা মরমীবাদে, কি’বা শিল্প সংস্কৃতি চর্চায়, কি’বা মানবতাবাদী অমরগাঁথা সৃষ্টিকর্মে। যার নেপথ্যে সরাসরি ভূমিকা পালন করে থাকেন, তাঁর গুরুরূপী কোন মহামানব।
জগতের মানব সভ্যতার ইতিহাসে কেবল-ই নবী-রাসুলগণের (দ.) শিক্ষা গুরুর দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহ। তাঁর স্বর্গীয় দূত জিবরাইলের (আ.) মাধ্যমে। তাদেরকেও কঠোর সাধনা করতে হয়েছে। কেউ হেরা পর্বতের গুহায়। কেউ কূহেতুর পাহাড়ে। কেউ অশ্বথ গাছের তলে।
নবী-রাসুল (দ.) ব্যতীত অন্যান্য সকল মহামানবকে কঠোর সাধনা করতে হয়েছে বা হয় একজন দীক্ষা গুরুর আদেশ-নির্দেশ মান্য করে করে-ই।
তাইতো সিলেটের মরমী সাধক আরকুম শাহ্ (রহ.) তাঁর অমর গাঁথা রচনায় বলেছেন-
“বাপের ধনে বেটা মহাজন রংপুরের বাজার।” এখানে বাপ হলেন গুরু; শিষ্য হলেন বালক। ভাববাদী দর্শণে গুরু-শিষ্য বাপ-বেটার মতন।
ফকির আরকুম শাহ্ (রহ.) তাঁর অন্যান্য রচনায় বলেছেন-
“সৈয়দ শাহ্ আবদুল লতিফ নিজের বেশাত দিয়া, পাগল আরকুমের নৌকা দিয়াছেন সাজাইয়া।”
“মুর্শিদ ধরিও কান্ডার, অবুঝও বালকের নৌকা ডুবে যে
তোমার।”
“আমার নৌকায় তুমি মাঝি তোমার নৌকায় আমি, নৌকা ডুবি বেশাত গেলে কলঙ্কিনী তুমি।”
আরকুম শাহ্ (রহ.) এর মতো আর কেউ গুরু-শিষ্য কিংবা মুর্শিদ-বালক তত্ত্ব এতো চমৎকার ভাবে প্রকাশ করেছেন বলে আমার জানা নেই।
লালন ফকির তাঁর অসংখ্য গানে গুরু সিরাজ সাঁই এর চরণ বন্দনা করেছেন বটে। কিন্তু বর্তমান সময়ে কিছু কিছু আধুনিক লালন গবেষক বলছেন, সিরাজ সাঁই নাকি বাস্তবে কেউ ছিলেন না। সিরাজ সাঁই লালনের-ই একটা কল্পরূপ।
আমি এক লালন পন্ডিতকে বললাম, তাহলে লালন সিরাজ সাঁই এর চরণ বন্দনা করলেন কেন? তিনি এর সঠিক জবাব দিতে পারেন নি। তবে লালন সাধক শফি মন্ডল বলেছেন, লালন ভাববাদী দর্শনের দার্শনিক। সুতরাং তাঁর ভাব বিশ্বাসে সিরাজ সাঁই তাঁর গুরু। এতে কোন সন্দেহ নেই।
হাছন রাজার মুর্শিদ বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জের রণকেলী (রণিকাইল) পাঞ্জাবী পীর সাহেবের বাড়ি। যা হাজার হাজার লোকের জানা রয়েছে এবং জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ (হাছন রাজার দৌহিত্র) ও স্বীকার করেছেন।
হাছন রাজা তাঁর বজরা (পানশী নৌকা) নিয়ে যখন রণকেলী যেতেন, তখন দু’টি জায়গায় যাত্রাবিরতি করতেন। তার একটি আমাদের (বিশ্বনাথের হরিপুর বড়বাড়ি) বাড়ি। আমার প্রপিতামহ আশরাফ আলী চৌধুরীর সাথে হাছন রাজার সখ্যতা ছিল এবং বরইকান্দির সুলতান মিয়া চৌধুরী হাফিজ সাহেবের বাড়ি। হাফিজ সাহেবের সাথেও হাছন রাজার সখ্যতা ছিল।
এতকিছু সত্য বিষয়কেও বর্তমানে নাকি কেউ একজন
বলেন, হাছন রাজার কোন গুরু ছিলেন না। তাঁর মুর্শিদ তিনি নিজে-ই ছিলেন!
বর্তমান যুগটি হচ্ছে গুরুকে টেক্কা মেরে শিষ্যের উত্থানের যুগ। যেমন রাজনীতিতে, তেমন সমাজনীতিতে, তেমন ধর্মকর্ম, শিল্প-সংস্কৃতি ও ভাববাদী দর্শণে!
আগামী দিনে ইতিহাস বিকৃতি আরো যে কত হবে। তার হিসাব নিকাশ মেলানো অসম্ভব হবে। তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
সাধুবাদ জানাচ্ছি মহান সাধক আরকুম শাহ্কে, সেই সাথে তাঁর ভাব শিষ্যদেরকে। জয় হোক গুরু-শিষ্য দর্শণের, জয় হোক বিশ্ব মানবতার।
মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীঃ কবি, সাহিত্য সমালোচক, চেয়ারম্যান- বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাব।
(অনুলিখনঃ স’লিপক)