পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ; শোকে কাতর নীল আকাশ
-মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী
জগতে সবচেয়ে করুন দৃশ্য হচ্ছে পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ। যে চিত্র দেখে শোকে কাতর নীল আকাশ।মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পুত্রগণ মারা গেলেন রাসুল (সাঃ) এর জীবদ্দশায়। সেই শোকে তিনি ছিলেন কাতর।
ঠিক তেমনি ঘটনা ঘটেছে আমার প্রপিতামহ আশরাফ আলী চৌধুরীর জীবদ্দশায়! তিন পুত্র ছয় কন্যার মধ্যে তিন পুত্র ও তিন কন্যা-ই মারা গেছেন তাঁর জীবদ্দশায়!
বড় ছেলে আব্দুর রহমান চৌধুরীকে শত্রুরা বেদ বান মেরেছিল আর এতে করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মেজো ছেলে আব্দুস সোবহান চৌধুরী ও আব্দুর রহিম চৌধুরী এবং তাদের তিন বোন কলেরায় মারা গেলেন।
শোকে কাতর থেকে পাথর হয়ে গেলেন আমার প্রপিতামহ। আমার দাদা মারা যাবার আগে আজান দিয়ে বলেছিলেন আমার ছেলেকে এনে দাও! আগেকার সময়ে কলেরায় আক্রান্ত হলে মানুষের কী যে কষ্ট হতো। তা কেবল কলেরা রোগ থেকে বেঁচে যাওয়া লোক ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
আমার পিতা তখন মায়ের গর্ভে! দাদার মৃত্যুর চার মাস পরে তাঁর জন্ম হয়। বাবার দাদা তিন পুত্র তিন কন্যা হাঁরিয়ে নাতির মুখ দেখতে পেয়ে কিছুটা হলেও আশান্বিত! বংশের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছেন মহান আল্লাহ!
পিতা জন্ম নিলেন তাঁর নানার বাড়ি বুরাইয়া গ্রামে! মেজো মেয়ে মফিজা ভানু (দাদার বোন দাদীও) কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ভেবে কবর খনন করা হয়।গোসলের সময় হঠাৎ হাতের আঙুল নড়ে ওঠলে সবাই আল্লাহ আল্লাহ ধ্বনি তোলে ঘরে নিয়ে আসেন! তিনি বেঁচে যান।
আমার পিতার বয়স তখন তিন থেকে চার বছর! ফের কলেরা রোগে আক্রান্ত এলাকা। আমার পিতাও আক্রান্ত হলেন। আমার প্রপিতামহ নামাজের জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদায় পড়ে গেলেন। হে আল্লাহ আমার জীবন দিয়ে হলেও আমার নাতিকে হায়াত দারাজ করুন। আমার নাতির বদলে আমাকে নিয়ে নেন পরপারে!
আমার দাদী মফিজা ভানু বললেন, রাতে হঠাৎ সিন্দুকের
তক্তা (কাঠ) ভেঙে যাবার শব্দ শুনে দৌঁড়ে সবাই ঘরে আসলাম। হায় হায়! আমার বাপজান আর নেই ইহলোকে! তিনি পরলোক গমন করেছেন।
আমার পিতার বয়স তখন সাত থেকে আট! আমার পিতাকে তাঁর মা ডেকে বললেন, জীবনে হারাম টাকা উপার্জন করবা না। মিথ্যা বলবা না। ঘুষের চাকরী করবা না। শিক্ষকতা চাকুরী করে জীবন চালিয়ে নিবা। মায়ের কথা কি মনে থাকবে?
-হ্যাঁ মা মনে থাকবে।
এরপর দাদী পাড়ি দিলেন পরপারে!
ভাইয়ের ছেলেকে লালন পালন করলেন আমার দাদার বোন দাদী! তিনি নিঃসন্তান এবং খাঁটি ধার্মিক ছিলেন। আমাদের আট বোন সহ আমাকেও অতি আদর যত্ন করতেন তিনি।
দাদী মফিজা ভানু একবার অসুস্থ হলেন। সিলেটে ডাক্তার আবুল লেইস সাহেবের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি চেকআপ করে বললেন রোগী একদম জীর্ণশীর্ণ!
বাড়িতে এসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ
আমার হায়াত থেকে দশ বছর তাঁকে আয়ু দান করলাম। আপনি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখুন! তাঁহার বড় সাধ! আমার সন্তান দেখতে চান! আমার বড় ছেলে মহসিন জন্ম নেয় ১৯৮৭ সালে! আর তিনি পরলোক গমন করেন ১৯৮৮ সালে।
আমার পিতা পরলোক গমন করেন ২০০০ সালে। আমার মা আমার পাঁচটি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে লালন পালন করলেন। একবার আমার মা খুবই অসুস্থ! দুই দিন দানাপানি কিছু-ই খান নি! আমি আবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম, আমার হায়াত থেকে দশ বছর তাঁকে আয়ু দান করলাম হে আল্লাহ। আমার মা ২০২০ সালে পরলোকে চলে গেলেন।
আমাকে একবার অসুস্থ শুনে আমার স্নেহভাজন কবি জাকারিয়া আনসারী জিকরা বললেন, আমার হায়াত থেকে এক বছর আপনাকে দান করলাম। এরপর আমার ছোট বোন যার বয়স আমার থেকে ৬ বছর কম। সেও মারা গেলো ২০২১ সালের প্রথম দিকে।
হয়তো কারো পরমায়ু আমাকে দান করেছেন, তাই হয়তো বেঁচে আছি। নাহয় তো আমার আয়ু বৃদ্ধি করেছেন মহান আল্লাহ। তাই লক্ষ কোটি শুকরিয়া আদায় করছি মহান আল্লাহর দরবারে।
জগৎ জীবন বড্ড কঠিন আর বড় সুখের! যখন আমরা মানুষকে আন্তরিকতার সাথে ভালবেসে ফেলি, তখন-ই স্বর্গ এসে ধরা দেয় মাটির ধরণীতে।
হে আল্লাহ, হে মহাবিশ্বের মহাপরাক্রমশালী প্রভু। আপনি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখুন সত্যবাদীর দলে। আমার সন্তানাদিকে মানুষের মতো মানুষ করে বাঁচিয়ে রাখুন।
মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীঃ কবি, চেয়ারম্যান- বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাব।
(অনুলিখনঃ স’লিপক)