আজ-  ,


সময় শিরোনাম:
«» শ্রীমঙ্গলে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার চুরি হওয়াতে দুর্ভোগে গ্রামবাসী «» বগুড়া সান্তাহারে নারী মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার «» কাজী নিবাস-এর আয়োজনে ইফতার ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ «» মৌলভীবাজারে বেড়েছে কিশোর গ্যাং অতিষ্ঠ জনজীবন ____মোয়াজ্জেম চৌধুরী «» কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে চেয়ারম্যান প্রার্থী অধ্যাপক রফিকুর রহমানের সমর্থনে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত «» কমলগঞ্জে শমশেরনগরে রেলপথ ঘেষে জমে উঠে অবৈধ পশুর হাট; দুর্ঘটনার আশঙ্কা «» নওগাঁয় প্রচন্ড তাপদাহে হাসপাতালে বেড়েছে রোগী «» বগুড়ায় শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের উদ্যোগে পথচারীদের বিশুদ্ধপানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ «» মৌলভীবাজারে চোরাই গাড়ি বানিয়াচং থেকে উদ্ধার : গ্রেফতার ১ «» জগন্নাথপুর উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি শংকর রায় এর মৃত্যুতে বিভিন্ন মহলের শোক প্রকাশ

আপনি শরীয়ত মুতাবেক আদায়কারী হচ্ছেন ত আপনার বোনের মিরাসের

কে এস এম আরিফুল ইসলাম::

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ও সভ্যতার প্রাথমিক ইউনিট হলো পরিবার। একই পরিবারে বাস করেন মা-বাবা, ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী প্রভৃতি রক্তসম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় আপনজন। এদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য। রক্তসম্পর্কীয় আপনজনের মধ্যে ভাইবোন হলো সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ।

এখানে ভাই-বোন বলতে আপন বা একই ঔরসজাত ভাই-বোন বোঝানো হচ্ছে। আরবিতে যাদের জিরেহেমে এবং বাংলা ভাষায় সহোদর বা একই মায়ের গর্ভের ভাই-বোন বলা হয়। ভাই-বোনের সম্পর্ক মধুর সম্পর্ক। বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণীর এবং বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে অধিকার দ্বারা সম্মানিত করেছে ইসলাম। ইসলাম কারো হকের ব্যাপারে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়নি। সবাইকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করেছে এবং সব মুসলিমকে আদেশ প্রদান করেছে অন্যের হক সঠিক ও যথাযথভাবে আদায় করার জন্য। মহানবী হযরত মহাম্মদ [সা.] এর মৌলিক মিশনই ছিল কারো হক বা অধিকার নষ্ট না করা। তিনি বলতেন, কোনো মুসলিম অন্য কারো হক বা অধিকার নষ্ট করতে পারে না। ভাই-বোনের হক বা অধিকারের প্রতিও ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছে। হাদিসে বড় ভাইকে বাবার সমান এবং বড় বোনকে মায়ের সমান বলা হয়েছে। সুতরাং একজন সন্তানের ওপর মাতা-পিতার যেসব হক বা অধিকার রয়েছে, বড় ভাই ও বড় বোনের ব্যাপারেও ছোট ভাই এবং ছোট বোনদের একই হক বা অধিকার।

আবার আমরা সবাই নামাজ পড়ি। নিজেদের মুসলমান দাবি করি। কিন্তু হক্কুল ইবাদাতের প্রতি আমাদের কোন নজর নেই। ভ্রুক্ষেপ নেই। অন্যের হক নষ্ট করাকে কোন অপরাধ মনে করি না।অন্যের অধিকার হরণ করায় আমাদের মনে ‘পাপবোধ ও চিত্তে অস্বস্তি ’ অনুভূত হচ্ছে না। দীন মেনে না-চলা, নীতি-নৈতিকতা বর্জিত ক্ষয়ে-যাওয়া সমাজ বোদ্ধামহলে ঘৃণিত। অধিকার হরণকারী পাপিষ্ঠ। এ চেতনা ও অনুভূতি যেন আজ লুপ্তপ্রায় । অন্যের অধিকার হরণও করছে, নামাজও পড়ছে। এমন নামাজি ব্যক্তির নামাজের সওয়াব হকদারদের নিকট চলে যাবে। এই জন্য ভাই, ভাল করে দীন বুঝার চেষ্টা করুন।ধর্ম শাসিত জীবন গড়–ন। দেনা-পাওনার ব্যাপারে সচেতন হোন।

আজকে আমরা অনেকেই আছি খুব ভাল নামাজ পড়ি কিন্তু নিজের আপনজনকে আঘাত করি। কষ্ট দিই। অধিকার বঞ্চিত করি। আমরা ধর্ম থেকে দূরে ছিটকে পড়েছি। তাই অন্যের অধিকার সংরক্ষণ ও পাওনা আদায়ে অভাবিত শিথিলতা প্রদর্শন করছি। যা মোটেই ঠিক নয়। আমরা নষ্ট সমাজরীতি অনুসরণ করছি। ধর্মের মিরাস নীতির বাস্তব প্রয়োগ না করে এ সম্পর্কে অনবগতই থেকে যাচ্ছি। আমাদের এ অজ্ঞতা পাপের দ্বার উন্মোচিত করে। ফলে আমরা পৈতৃক সম্পত্তিতে সুষম বণ্টনে ব্যর্থ হই। বণ্টন বৈষম্যের শিকার হই। বঞ্চিত করি বোনকে। বোন লজ্জায় কিংবা সম্মান রক্ষার্থে তার পাওনা দাবি করছেন না। ভাইদের প্রতি সদয় আচরণ দেখালেন। কিংবা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পৈতৃক সম্পত্তি দাবি করলে ভাইদের সঙ্গে ‘সম্পর্ক ছিন্নের ভয়ে’ শঙ্কিত। তাই বলেন,‘ বাপের সম্পত্তিতে আমার কোনও দাবি নেই।’ ব্যস, ভাইয়েরা পার পেয়ে গেলেন! আর আনন্দে গদগদ করে জাবর কাটলেন ‘ আমি তো দিতে চেয়েছি , বোনই তো নেয়নি।’ না, ভাইদের এমন দায়িত্বহীনতা ও লোলুপ মানসিকতা কাম্য নয়।

একটু ভেবে দেখুন । বোন সম্পত্তি নিতে মৌখিক অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বটে, কিন্তু নিজেকে একটু জিজ্ঞেস করুন।লক্ষ করুন এতে তার চেহারা ও হৃদয়ে আনন্দ না বেদনার ছাপ পড়েছে? তার হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ বইছে না রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে? চাপা-বেদনায় তার হৃদয় ফেটে চৌচির হচ্ছে না তো? যাতনাক্লিষ্ট হয়ে আড়ালে চোখের অশ্রু মুছছেন না তো? তার এ অস্বীকৃতি কি সন্তুষ্ট চিত্তে হয়েছে না সমাজরীতির ভয়ে? আপনি ভাই হয়ে বোনের চোখের জল মুছে দিতে পারলেন না। বরং বোনকে অধিকার বঞ্চিত করে কাঁদালেন। নিজ থেকে আপনি বোনের জন্য কী করলেন? পৈতৃক সম্পত্তিতে বোনের অধিকার হরণ করার তো কোনও অধিকার আপনার নেই। ভুলে যাবেন না। এটা বোনের অধিকার। তার প্রতি আপনার অনুগ্রহ নয়। আপনার যেমন পিতার সম্পত্তিতে অধিকার আছে তেমনি তারও আছে। আপনি তার হক তাকে বুঝিয়ে দিন।পিতার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদে মেয়ের অধিকার আছে। আপনি ভাই হিসেবে বোনের শরিয়তমাফিক অধিকারগুলো আদায় করুন।এটা আপনার দায়িত্ব। দায়িত্বে হেলা করলে কেয়ামতের মাঠে ফেসে যাবেন। ঘৃণা করুন সেই সমাজরীতিকে । যেখানে বোনের অধিকার লুণ্ঠিত হয়।

আপনি ভাই হয়ে বোনের চোখের জল মুছে দিতে পারলেন না। বরং বোনকে অধিকার বঞ্চিত করে কাঁদালেন। নিজ থেকে আপনি বোনের জন্য কী করলেন? পৈতৃক সম্পত্তিতে বোনের অধিকার হরণ করার তো কোনও অধিকার আপনার নেই।

বোনের মুখের হাসি কেঁড়ে নেয়। ইসলামকে জানুন। ইসলামে উত্তরাধিকার স্বত্ব তথা মিরাস বিধান সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করুন।মিরাস বিধান অনুযায়ী বোনকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে নিজে দায়মুক্ত হোন। দায়িত্ব সচেতনতার পরিচয় দিন। নিঃস্বার্থভাবে ভাই-বোনের সম্পর্ক আজীবন ধরে রাখুন। বোনের সম্পত্তি ভোগ-দখল করার জন্য মিকি ভালবাসা আর সম্পর্কের কী মূল্য আছে? বোনকে তার অধিকার বুঝিয়ে দেওয়াই তো ভাইবোনের সুসম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। বর্জন করুন সেই সমাজরীতি ও মানসিকতাকে ।যেখানে বোন তার অংশ নিয়ে নিলে আর বাপের বাড়ি আসতে পারে না। সম্পর্কের টানাপোড়েন চলে। আসুন যেনে নেওয়া যাক ভাইয় বোনের সম্পর্কীয় কিছু জরুরী কথা।

ভাইয়ের উপর বোনের লালন-পালন, ভরণ-পোষণ ও সেবা-যত্নের গুরুত্ব:

বাবার অপারগতা বা অবর্তমানে বোনের লালন-পালন, উপযুক্ত পাত্র দেখে বিয়ে দেওয়া ভাইয়ের দায়িত্ব। এব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার তিনটি মেয়ে রয়েছে অথবা তিনজন বোন রয়েছে কিংবা দুই বোন বা দুই মেয়ে রয়েছে, অতঃপর সে তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করে, উত্তম পাত্র দেখে বিয়ে দেয় এবং তাদের সঙ্গে সর্বোত্তম ব্যবহার করে। তার জন্য জান্নাত অবধারিত’- (তিরমিজি, আবু দাউদ)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এতে আনন্দিত হয় যে তার রিজিক প্রশস্ত হবে ও আয়ু বৃদ্ধি পাবে, যে যেন আত্মীয়তা বজায় রাখে’- (বোখারি, মুসলিম)।

বোনের সন্তুষ্টি ছাড়া তাকে বিয়ে বা তালাকে বাধ্য করা যাবে না::

অনেক ভাই স্বামীর অব্যাহত অত্যাচারে অতিষ্ঠ বোনকে ভরণ-পোষণের ভয়ে জোর করে স্বামীর বাড়ি পৌঁছে দেয়। কোনো কোনো পরিবারে মেয়েদের দ্বিতীয় বিয়ে থেকে বিরত রাখে। আবার অনেকেই তালাকের পরও বৈবাহিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইসলামের সীমার মধ্যে হলে এসব বিষয়ে বোনের ওপর বলপ্রয়োগের অধিকার ভাইকে দেওয়া হয়নি। প্রায়ই দেখা যায়, তালাকপ্রাপ্তা বোনেরা ভাইয়ের সংসারে অবজ্ঞা ও নিগ্রহের শিকার হয়, তাদের ইমান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বলা হয়েছে, ‘(তালাক ও ইদ্দতের পর) পূর্বস্বামীদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে তাদের বাধা দান করো না। এ উপদেশ তাকেই দেওয়া হচ্ছে, যে আল্লাহ ও কিয়ামতের দিনের ওপর বিশ্বাস রাখে’- (সুরা নিসা : ২৩২)

বোনের জন্য প্রয়োজনে নিজের স্বার্থকেই বিসর্জন দিতে হবে::

হযরত জাবের (রা.)-এর একটি ঘটনা খুবই স্মরণীয়। রাসুল (সা.) তাকে বলেছেন, ‘তুমি কুমারী নারী বিয়ে না করে তালাকপ্রাপ্তা নারীকে বিয়ে করেছ কেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমার বাবা মারা গেছেন। আমার ছোট ছোট কয়েকজন বোন রয়েছে, তাদের লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার জন্যই আমি বয়স্ক নারী বিয়ে করেছি। ‘ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন’- (বোখারি, মুসলিম)। এই হাদিস থেকেই তে বোঝা যায়, পরিবার বা বোনের জন্য প্রয়োজনে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে।

বোনের উত্তরাধিকার সম্পত্তি গ্রাস করা যাবে না::

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তার অধিকার দিয়ে দাও’- (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬)

কিন্তু বড়ই আফসোস ও পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে ভাইয়েরা ছলেবলে-কৌশলে বোনদের প্রাপ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে গেছে, ভাইয়ের কাছ থেকে প্রাপ্য নেওয়াটাকে সমাজের চোখে ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখা হয়। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধিকার সম্পত্তি গ্রাস করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন’- (মেশকাত শরিফ)।

বড় ভাই বোনদের সাথে কিরুপ ব্যবহারকারী হতেহবে ::

১. বড় ভাই ও বড় বোনকে সম্মান করা। অর্থাৎ বড় ভাই ও বোন হিসেবে সে যে পরিমাণ বা যতটুকু সম্মানের অধিকার রাখে, ঠিক ততটুকু সম্মান প্রদর্শন করা। এ ক্ষেত্রে কোনো কমতি না করা এবং খুব বেশি বাড়াবাড়িও না করা।
২. তাদের কথা মেনে চলা। অর্থাৎ শরিয়তের খেলাফ যদি কোনো আদেশ তারা না করে, সে ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অজুহাত না দেখিয়ে যথাসময়ে আদেশ পালন করা। কিন্তু যদি এমন হয় যে, বড় ভাই ও বোন শরিয়ত বিরোধী কোনো কাজের আদেশ করছে, সে ক্ষেত্রে তাদের আদেশ না মানলে হক বা অধিকার নষ্ট করা হবে না।
৩. তাদেরকে কোনো প্রকার কষ্ট না দেয়া। অর্থাৎ শারীরিক বা মানসিক কোনো প্রকার কষ্ট বড় ভাই ও বোনকে না দেয়া এবং কষ্ট পেতে পারে, এমন কাজের পরিকল্পনাও না করা।
৪. প্রয়োজনমাফিক তাদের আর্থিক সাহায্য করা। অর্থাৎ এমনও হতে পারে যে, বড় ভাই ও বোন আর্থিকভাবে ছোট ভাই বা বোনের তুলনায় দুর্বল। সে ক্ষেত্রে ছোট ভাই ও বোনদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে ইসলামী শরীয়ত মুতাবেক বড় ভাই-বোনদের হক বা অধিকার সঠিকভাবে আদায় করার সেই তাওফিক দান করুন।

লেখক::
কে এস এম আরিফুল ইসলাম
সাংবাদিক ও সিনিয়র সহকারী শিক্ষক
দারুল আজহার ইনস্টিটিউট
শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।